লাইসোজোমের ধারণাঃ
কোষের সাইটোপ্লণাজমে অবস্থিত অপর একপ্রকার অতিক্ষুদ্র কোষ অঙ্গাণু যা বিভিন্ন ধরনের পাচনকারী এনজাইম বহনপূর্বক কোষস্থ খাদ্য কণাকে পাচিত করে, তাদের লাইসোজোম বলে। কাজেই লাইসোজোমকে কোষের পাচনকারী দেহ বলা হয়। লাইসোজোমের অভ্যন্তরে অবস্থিত এনজাইমগুলোকে লাইসোজাইম বলা হয়। লাইসোজোমের ত্রিয়ায় কোষস্থ খাদ্য কণার ভাঙন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বলে এ অঙ্গাণুটিকে লাইসোজোম নামে অভিহিত করা হয়েছে। এনজাইমের উপস্থিতির জন্য লাইসোজোমকে কোষের এনজাইমের প্যাকেটো বলা হয়।
আবিষ্কারঃ
১৯৪৯ সালের দিকে প্রাণীর যকৃৎ কোষে এক ধরনের ফোস্কার মতো ক্ষুদ্রাকার কোষ অঙ্গাণু বিজ্ঞাণীগণ প্রত্যক্ষ করলেও ১৯৫৫ সালে দ্য দ্যবে এবং তার সহকর্মীবৃন্দ (De Duve) ইদুরের যকৃৎ কোষে প্রথমে লাইসোজোম আবিষ্কার করেন।
প্রাপ্তি স্থানঃ
স্তন্যপায়ী প্রাণীর লোহিত রক্ত কণিকা ব্যতীত প্রায় সব ধরনের কোষেই লাইসোজোম পাওয়া যায়। প্রাণী ছাড়াও কোন কোন উদ্ভিদ কোষে লাইসোজোম আছে বলে জানা গেছে। সাধারণত যে সমস্ত কোষের পচন ক্ষমতা ও রোগজীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে সে সমস্ত কোষেই এদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
গঠনঃ
লাইসোজোমের আকার গোলাকার বা বর্তুলাকার। এর ব্যাস ০.৪-০.৮ মাইক্রো মিটার। একটি বৃহদাকার লাইসোজোমের ব্যাস প্রায় ৫ মাইক্রো মিটারও হতে পারে। প্রতিটি লাইসোজোম একটি আবরণী দ্বারা আবৃত। আবরণীটি ত্রিস্তরী এবং এটা রবার্টসন বর্ণিত একক মেমব্রেন মডেল অনুযায়ী গঠিত। আবরণীর প্রধানতম উপাদান হলো লাইপোপ্রোটিন। লাইসোজোমের অন্তঃস্থল অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর অন্তঃস্থলে কেন্দ্রস্থ অংশটি ঘন হয় এবং পরিধিস্থ অংশটি হালকা (Light) হয়ে উঠে। আবার কেন্দ্রস্থ অংশটি হালকা হলে, পরিধিস্থ অংশটি ঘন হয়ে যায়। অনেক সময় লাইসোজোমের অন্তঃস্থলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাকুওল পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় এর মধ্যে কোষের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এবং কোষস্থ বিভিন্ন ধরনের জমাকৃত খাদ্য অর্ধ পাচিত অবস্থায় থাকতেও দেখা গেছে।
রাসায়নিক উপাদানঃ
লাইসোজোমের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে প্রধানতম হলো লাইপো-প্রোটিন। এছাড়াও লাইসোজোমের অন্তঃস্থলের একমাত্র উপাদান হলো এনজাইম। এনজাইমগুলো হাইড্রোলাইটিক এনজাইম নামে পরিচিত। এ হাইড্রোলাইটিক এনজাইমগুলো PH এর অ্যাসিডিক মাত্রার দিক নির্দেশ করে । লাইসোজোমে অবস্থিত হাইড্রোলাইটিক এনজাইমগুলো নিম্নোক্ত প্রকারের হয়। যেমনঃ
- লাইপো-প্রোটিন
- অ্যাসিড ফসফাটেজ
- অ্যাসিড ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিওয়েজ
- অ্যাসিড রাইবোনিউক্লিওয়েজ
- বিটা গ্লুকোরোনাইডেস
- ক্যাথেপসিন
- আলফা মনোসিডেজ
- সালফাটেজ
- ফসফো প্রোটিন ফসফাটেজ
- ফসফোলাইপেজ
- পেপটাইজডেজেজ
- কোলাজিনেজ
লাইসোজোমের কাজঃ
- বহিঃকোষীয় বস্তুর পাচন (Digestion of Extracellular materials): কোষ বহির্ভূত কোনো বস্তু এবং রোগজীবাণু পিনোসাইটোসিস এবং ফ্যাগোসাইটোসিস পদ্ধতিতে কোষ মধ্যে প্রবেশ করলে লাইসোজোমের ক্রিয়ায় সেগুলো পাচিত এবং ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
- আন্তঃকোষীয় বস্তুর পাচন (Digestion of intracellular materials): কোষমধ্যস্থ বিভিন্ন জমাকৃত বস্তু যেমন- ফ্যাট, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট প্রভৃতি লাইসোজোম দ্বারা পাচিত হয়ে শক্তি নির্গত হবার উৎস সৃষ্টি করে।
- অটোফেগী (Autophagy) ক্রিয়াঃ কোষ মধ্যস্থ কোনো কোনো অঙ্গাণু অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেলে লাইসোজোম সেগুলোকেও পাচিত করতে সক্ষম। লাইসোজোমের এ ক্রিয়াকে অটোফেগী বা অটোলাইসিস বলে। পাচনকৃত কোষ অঙ্গাণুগুলো লাইসোজোমের ভিতরে অবস্থান করে এবং আবরণী দ্বারা আবৃত হয়। একে অটোফেগিক ভ্যাকুওল বলে। এ অটোফেগিক ভ্যাকুওল কোষের বাইরে প্রক্ষিপ্ত হয়।
- রেসিডুয়াল বডি গঠন (Formation of Residual body): অনেক সময় লাইসোজোম অপাচ্য বস্তু ধারণপূর্বক রেসিডুয়াল বডি গঠন করে। লাইসোজোমে এনজাইমের অভাব হলে এরূপ অবস্থা হয়।
- নিউক্লিও আবরণী ভাঙন (Brake down of nuclear Membrane): কোষ বিভাজনকালে লাইসোজোম নিউক্লিও আবরণী ভাঙতে সহায়তা করে বলে অনুমিত।
- কোষের ভাঙন (Brake down of Cell): লাইসোজোমের এনজাইমগুলো একটি সম্পূর্ণ কোষকে ভেঙে দিতে পারে।
- অপ্রয়োজনীয় বস্তুর বর্জন (Excretion of unnecesssary substances): প্রোটোজোয়াসমূহে লাইসোজোম সঙ্কোচনশীল গহ্বর হিসেবে কাজ করে এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বস্তু কোষদেহের বাইরে বর্জন করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
- হরমোন নিঃসরণ (Hormone secretion): অনেক কোষবিদ মনে করেন গ্রন্থিকোষ হতে হরমোন নিঃসরণে লাইসোজোমই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।