ভিটামিনঃ যে সকল জৈব যৌগ অল্প মাত্রায় জীবের পুষ্টি, স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও প্রজননে প্রয়োজন হয় তাকে ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ বলে।
ভিটামিন A :
রাসায়নিক নামঃ রেটিনল।
উৎসঃ গাজর টমেটো, বাঁধাকপি, পালংশাক, লালশাক, লেটুসপাতা, মিষ্টি কুমড়া, যে কোনো ধরনের সবুজ শাকসবজি, ছোলা, যকৃত, ডিমের কুসুম, কৈ মাছের তেল, দুধ, ডিম ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে Vitamin-A থাকে।
ভিটামিন-A এর কাজঃ
- শারীরিক বৃদ্ধির জন্য Vitamin-A একান্ত প্রয়োজন।
- দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।
- জিহ্বা, গলবিল, শ্বাসনালী, লালাগ্রন্থি প্রভৃতির আবরণী কলাকে সজীব ও সক্রিয় রাখে।
- ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে।
- খাদ্য পরিপাকে সহায়তা ও ক্ষুধামন্দা দূরীভূত করে।
- জননাঙ্গ গঠন ও সন্তান উৎপাদনে Vitamin-A উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
অভাবজনিত লক্ষণঃ
- Vitamin-A এর অভাবে দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
- রাতকানা রোগ হয়।
- মারাত্মক অভাবে কর্ণিয়া বিনষ্ট হয়ে যায় এবং চোখে ছানি পড়ে।
- দাঁত ও হাড়ের বিকৃতি ঘটে।
- খাদ্যনালীতে Vitamin-A এর অভাবে মিউকাস পর্দা নষ্ট হয়ে যায় এবং ডায়রিয়া হতে সাহায্য করে।
- Vitamin-A এর অভাবে প্যারালাইসিস ও স্নায়ুবিক রোগ হতে পারে।
ভিটামিন D :
রাসায়নিক নামঃ ক্যালসিফেরল।
উৎসঃ সামুদ্রিক মাছ, মাছের তেল, দুধ, মাখন, ডিমের কুসুম, গরু ও খাসির যকৃত এবং হাঙরের তেলে ভিটামিন-ডি পাওয়া যায়। এছাড়া সকাল বেলা ও বিকাল বেলার সূর্যের UV রশ্মির প্রভাবে মানবদেহে Vitamin-D Synthesis হয়।
ভিটামিন-D এর কাজঃ
- ক্যালসিয়াম সঞ্চয়ে সাহায্য করে।
- অস্থির বৃদ্ধি এবং সুস্থ ও মজবুত হাড় গঠনে সহায়তা করে।
- দাঁতের ক্ষয়রোধ করে, দাঁতের স্বাভাবিক অবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে সহায়তা করে।
- হাড়ের Ca2+ ও রক্তের Ca2+ এর মধ্যে সমতা আনয়ন করে।
- দেহের ত্বককে মসৃণ ও কোমল করে।
অভাবজণিত লক্ষণঃ
- Vitamin-D এর অভাবে শিশুদের রিকেটস নামক রোগ হয়।
- প্রাপ্ত বয়স্ক লোকদের Vitamin-D এর অভাবে ম্যালেরিয়া হতে পারে।
- অস্থি নরম ও অপরিণত হওয়ায় দেহের চাপে বেঁকে যায়।
- এর অভাবে শিশুদের মাথার সামনের দিক, হাতের কব্জি এবং পায়ের গোঁড়ালি ইত্যাদি মোটা হয়ে যায়।
- দাঁত উঠতে বিলম্ব ঘটে।
- সর্বোপরি হাত, পা বিকৃত আকার ধারণ করে।
ভিটামিন E :
রাসায়নিক নামঃ টোকোফেরল। একে Anti-Steritity Vitamin ও বলা হয়।
টোকোফেরল কয়েক প্রকার হতে পারে। যেমন- i) আলফা টোকোফেরল, ii) বিটা টোকোফেরল, iii) গামা টোকোফেরল।
উৎসঃ উদ্ভিদজাত তৈল, শাকসবজি, লেটুস পাতা, সয়াবিন, অংকুরিত ছোলাবীজ, মটরশুঁটি, ডিম, দুধ, মাছ, যকৃত ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে Vitamin-E পাওয়া যায়।
ভিটামিন-E এর কাজঃ
- যৌনাঙ্গের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে।
- গর্ভধারণ ও স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- ক্ষতস্থানের রক্তের বিকাশে সহায়তা করে।
- ক্ষত স্থানের রক্তের জমাট বাধা এবং করোনারী থ্রম্বোসিস এর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
- মাংসপেশির গঠনে যথাযথ ভূমিকা পালন করে।
অভাবজনিত লক্ষণঃ
- প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়, বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হয়।
- অকাল গর্ভপাত ঘটে এবং রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
- লোহিত রক্তকণিকাগুলোর ভাঙনের প্রবণতা দেখা যায়।
- অকাল বার্ধক্য দেখা দেয়।
ভিটামিন K :
রাসায়নিক নামঃ ভিটামিন-K দু’প্রকার। যথা K1 এবং K2। এদের রাসায়নিক নাম যথাক্রমে i) K1 = ফাইলোকুইনোন, K2 = ফারনোকুইনোন। ভিটামিন-K কে এন্টিহোমোরেজ ভিটামিনও বলা হয়।
উৎসঃ বাঁধাকপি, পালংশাক, টমেটো, সবুজ শাকপাতা, দুধ, মাখন, ডিম, শুঁটকি মাছ, ছোলা, চালের গুঁড়া ইত্যাদি। এছাড়া মানুষের অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া Vitamin-K সংশ্লেষণ করে।
ভিটামিন-K এর কাজঃ
- রক্তের প্রোথ্রোম্বিন ও ফ্যাক্টর-II এর মাত্রা বজায় রেখে রক্তের জমাট বাধা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে।
- রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- সবুজ কলায় Phosphorylation-এর জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে Vitamin-K কাজ করে।
- শ্বসনের ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে Vitamin-K ব্যবহার হয়।
- Apoenryme এবং Holoenryme গঠনে এটি প্রস্থেটিক গ্রুপ হিসেবে কাজ করে।
অভাবজনিত লক্ষণঃ
- Vitamin-K এর অভাবে রক্তপাত বন্ধে বিলম্ব ঘটে।
- রক্ত জমাট বাঁধতে বিলম্ব ঘটে।
- জন্ডিসরোগ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- Mitochondria-এর Oxidative Phosphorylation বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
ভিটামিন C :
রাসায়নিক নামঃ Ascorbic Acid (অ্যাসকরবিক এসিড)। এটি পানিতে দ্রবণীয় একটি ভিটামিন।
উৎসঃ আমলকি, লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, আনারস, কাঁচামরিচ, টমেটো, আমড়া, জলপাই, লেবু প্রভৃতি ফলের এবং উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে Vitamin-C প্রচুর পরিমাণে থাকে।
ভিটামিন-C এর কাজঃ
- জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন পরিবহনের মাধ্য রূপে এটি কাজ করে।
- কোলাজেন গঠন, অস্থি গঠন, লৌহ ও হিমোগ্লোবিনের বিপাক এবং ট্রিপটোফেন ও ফলিক এসিড বিপাকে সহায়তা করে।
- Steroid hydroxylase enzyme রূপে কাজ করে।
- হাড় ও দাঁতের গঠন ও পুষ্টিসাধনে Vitamin-C অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
- রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
- ক্ষত সারিয়ে তুলতে এবং ক্ষতিকারক দ্রব্যের ক্ষতি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে Vitamin-C দরকার।
অভাবজনিত লক্ষণঃ
- Vitamin-C এর অভাবে Scurvy নামক রোগ হয়। এর ফলে দাঁতের গোড়া স্পঞ্জের মতো হয়ে যায় এবং মাড়ি ফুলে যায়।
- দাঁত থেকে রক্ত পড়ে এবং দাঁত নড়বড় করে।
- দেহের ওজন হ্রাস পায় ক্ষুধামন্দা ও হাত পায়ের কব্জিতে যন্ত্রণা হয়।
- শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
- শরীরের ক্ষতস্থান শুকাতে দীর্ঘসময় লাগে।
ভিটামিন B :
Vitamin-B-Complex: ভিটামিন B আট (৮) ধরনের। যথা- B1, B2, B3, B5, B6, B7, B9 এবং B12 । এদের সম্মিলিতভাবে B-Complex বলা হয়। নিম্নে এদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো-
১। ভিটামিন B1 :
রাসায়নিক নামঃ Thiamine (থায়ামিন)। এটি মুক্ত অবস্থায় এবং যুক্ত অবস্থায় দু’ভাবেই থাকতে পারে। মুক্ত অবস্থায় থায়ামিন এবং যুক্ত অবস্থায় এর নাম থায়ামিন পাইরোফসফেট।
উৎসঃ শস্যের ভূষি, বীট, গাঁজর, ফুলকপি, সীম, বাদাম, লেটুসপাতা, ঈস্ট, ঢেঁকিছাঁটা চাল, ভাতের মাড়, ডিমের কুসুম, মটরশুঁটি, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি।
ভিটামিন-B1 এর কাজঃ
- কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট এবং প্রোটিন সংশ্লেষণে এনজাইমকে সহায়তা করে।
- স্বাভাবিক ক্ষুধা বজায় রাখে।
- স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে।
- হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে চলাচলে সহায়তা করে।
- বিপাক ক্রিয়ায়সহ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
- কোষের শ্বসনের জন্য Thiamine প্রয়োজন।
অভাবজনিত লক্ষণঃ
- Vitamin-B1 এর অভাবে দুর্বলতা ও হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা দেখা দেয়।
- ক্ষুধামন্দা, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা দেখা দেয়।
- এর অভাবে স্নায়ুর দুর্বলতা ও পক্ষাঘাত দেখা যায়।
- Vitamin-B1 এর অভাবে মস্তিষ্কে ক্ষত হয়ে মানসিক বৈকল্য ও বুদ্ধিহীনতা দেখা দিতে পারে।
- শিশুদের শরীরের পুষ্টি কমে যায়।
চলবে………………
Image source: www.pixabay.com